ইউক্রেনে হামলার পর থেকে জার্মানিতে শুরু হয়েছে রুশ বংশোদ্ভূত এবং রুশ ভাষাভাষীদের হয়রানি, নির্যাতন। রাস্তায় হামলার শিকার হচ্ছে শিশুরাও।

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হয়েছে হামলা। শিক্ষকদের রোষানলেও পড়ছে রুশ ভাষাভাষী শিক্ষার্থীরা। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডিডব্লিউ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দেশটিতে রুশ ভাষাভাষীর সংখ্যা ৬০ লাখের মতো। এদের বেশিরভাগই জার্মান।
তাদের পূর্বপুরুষরা এক সময় মধ্য ইউরোপের জার্মানভাষী বিভিন্ন দেশে ছিলেন। মূলত ১৮ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তারা রুশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে গেলেও প্রথমে ১৯৫০-এর দশকে এবং পরে ১৯৯০-এর দশকে পশ্চিম জার্মানিতে চলে আসেন। বর্তমান প্রজন্ম জার্মান। তবে রুশ ভাষা এবং সংস্কৃতিকে তারা ধরে রেখেছেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে সেই রুশ ভাষা এবং সংস্কৃতির সংশ্রবই বিপদে ফেলেছে তাদের।

রোমান ফ্রিডরিশ উপলব্ধি করছেন ইউক্রেনে ইউক্রেনীয়দের এবং জার্মানিতে ‘রুশদের’ জীবনে পরিবর্তিত সময়ের এই কষ্ট। কোলনের কোরভাইলার জেলার সমাজকর্মী ফ্রিডরিশের জন্ম রাশিয়ার ওমস্কে। তার দাদী ছিলেন ইউক্রেনীয়। সমাজকর্মী হিসেবে ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য কিছু করা তাই একান্ত কর্তব্য মনে করেছেন এবং সে কারণে গত কয়েক দিন ধরে তাদের সহায়তায়ই ব্যস্ত রাখছেন নিজেকে।


রাশিয়ার হামলার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া ইউক্রেনীয়দের পাশাপাশি রুশ ভাষাভাষী এবং রুশ বংশোদ্ভূতদের জীবনে নেমে আসা আকস্মিক সঙ্কটও ব্যথিত করছে ফ্রিডরিশকে। পুতিনের ইউক্রেন হামলার জন্য জার্মানিতে বসবাসরত রুশ ভাষাভাষী এবং রুশ বংশোদ্ভূতদের নানাভাবে হয়রানির কিছু ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একটা স্কুলে এক রুশ শিক্ষার্থীকে শিক্ষক বলেছেন উঠে দাঁড়িয়ে পুতিনের নীতির বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলতে- এই ঘটনাটা শুনে আমি হতবাক!’ ফ্রিডরিশ মনে করেন, এখনও খুব ব্যাপক পরিসরে না হলেও ঘরের বাইরে স্কুল, বাস-ট্রেন-ট্রামসহ বলতে গেলে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রুশ ভাষাভাষীরা যে হামলা এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তা বেশ উদ্বেগের।

কোলনের এক স্কুলে রুশ ভাষাভাষী ছাত্রকে পিটিয়েছে তার সহপাঠীরা। হার্ডওয়ারের দোকানে গিয়েছিলেন এক পোলিশ নারী। সেখানে উপস্থিতরা রুশ ভেবে এমন আচরণ শুরু করে যে দ্রুত চলে আসতে হয় সেই নারীকে।

ওবারহাউজেনে এক পোলিশ-রুশ দোকানে হামলার ঘটনা কোলনেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এক সুপারমার্কেটের মালিক এতটাই উদ্বিগ্ন যে, এখন ভয় রাশিয়ার তৈরি পণ্য রাখার কারণে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা হতে পারে। ফ্রিডরিশ মনে করেন, রাশিয়ার হামলার কারণে জার্মানিতে নির্দোষ মানুষদের হয়রানি, নির্যাতন অচিরেই বন্ধ করা উচিত।

তিনি বলেন, ‘কিছু সহিংসতার ঘটনা যেহেতু সামনে এসেছে, আইনি সংস্থাগুলোর উচিত এসবের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। মস্কোর কাজের দায়ভার এখানকার রুশদের ওপর চাপানো হচ্ছে- এটা চলতে দেয়া যায় না। আইনের শাসন কার্যকর করতে হবে। ’

বন শহরের উপকণ্ঠে রুশ ভাষা ও সংস্কৃতির স্কুল চালান নারিনা কারিৎস্কি। ২০১১ সালে খুব ছোট পরিসরে শুরু করা স্কুলটির পরিসর এখন অনেক বেড়েছে। স্কুলে এখন ২৫ জন শিক্ষক। ৫০০টি পরিবারের সন্তানদের রুশ ভাষার পাশাপাশি ছবি আঁকা, ব্যালে নাচ, এমনকি রোবোটিক্সও শেখান তারা। ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর নারিনা প্রথম আঘাতটি পান একটি মেইল পড়ে। তাতে এক শিক্ষার্থীর ইউক্রেনীয় মা লিখেছেন, ‘আপনার স্কুলে আমাদের বাচ্চারা যে পড়তে যায় তাতে আমরা খুব খুশি। রুশ আগ্রাসনের বিষয়ে আপনার কী অভিমত তা কি একটু জানাবেন?’ মেইলটি পড়ে নারিনা দুঃখের চেয়ে লজ্জা পেয়েছেন বেশি। তিনি বলেন, ‘এ (আগ্রাসনের) বিষয়ে আমরা কী ভাবছি তা জানা তার কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ। রুশ ভাষাভাষী হিসেবে আমরা যে কতটা লজ্জিত তা যে সবাইকে বোঝাতে পারছি না এটা ভীষণ লজ্জার। ’

একটি ফোনও এসেছিল নারিনার স্কুলে। সেখানে প্রতিবেশী পরিচয় দিয়ে এক লোককে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা এই রাস্তার কলঙ্ক। আপনারা খুনী!’

অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মা-বাবাই এখন চিন্তিত। সন্তানদের স্কুলে পাঠানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছেন না তারা। বাসে দুই ছাত্র রুশ ভাষায় কথা বলছিল। এ কারণে পুতিনের সমর্থক মনে করে তাদের ওপর হামলা করা হয়। এ ঘটনা শোনার পর থেকে অনেক মা-বাবাই সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত।

নারিনা কারিৎস্কি বলেন, ‘তাদের সন্তানের সঙ্গেও খারাপ কিছু ঘটতে পারে এমন ভয় পাচ্ছেন তারা। ’ তিনি মনে করেন, জার্মানিতে বসবাসরত এই মানুষগুলোর সঙ্গে যে ওই হামলার কোনো সম্পর্ক নেই তা সবার বোঝা উচিত। যুদ্ধটা জনগণের নামে করা হলেও এটা নিতান্তই পুতিনের যুদ্ধ।